অপারেশন দ্বারকাঃ ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের নৌ ফ্রন্ট

৭ই সেপ্টেম্বর, রাত ১১:৫৫,পাকিস্তান নৌবাহিনীর ২৫ ডেস্ট্রয়ার স্কোয়াড্রনের অপারেশনাল কমান্ডার, কমোডর এস এম আনোয়ার,তার সেনাদের গোলাবর্ষণের আদেশ দিলেন। সাথে সাথেই স্কোয়াডে থাকা ৬টি ডেস্ট্রয়ার আর ১টি ফ্রিগেট গোলাবর্ষণ শুরু করলো। তাদের লক্ষ্য,কাছের ভারতীয় শহর-দ্বারকা।

গুজরাটের জামনগরের দ্বারকা শহরের আরেক নাম,দেবভূমি। মহাভারতের দেবতা শ্রী কৃষ্ণ যে,এই শহরের রাজপুত্র ছিলেন। ভারতবাসীর কাছে তাই এই শহরের আলাদা একটা গুরত্ব ছিল। দ্বারকা আক্রমণ তাই পাকবাহিনীর কাছে যতটা না সামরিক,তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। ৬৫’র যুদ্ধে হঠাত পাঞ্জাব আর কাস্মীর আক্রমণ করে বসা পাকিস্তান,যুদ্ধ শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই টের পায়। যুদ্ধ চালানো মোটেও সহজ কিছু নয়। দক্ষিণে কাস্মীর আর পাঞ্জাবে ক্রমাগত আক্রমণের কারণে,পাকবাহিনীর অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। তাই,তাদের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য পাক সেনা কমান্ড,দ্বারকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত দ্বারকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন জোরদার ছিল না। আর ভারতীয় নৌবাহিনীও সেসময় এধরনের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। পাক কমান্ড অবশ্য চেয়েছিল,ভারতীয় নৌবাহিনী যাতে এই অপারেশনে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কারণ,বোম্বেতে থাকা ভারতীয় জাহাজগুলো বের হলেই,সেগুলো ডুবিয়ে দিতে ওঁত পেতে ছিল,পাকিস্তান নৌ বাহিনীর একমাত্র সাবমেরিন পিএনএস গাজী।
পাক নৌবাহিনীর অপারেশনাল অবজেক্টিভ ছিল ৪টি। যথাঃ
*শত্রু ইউনিটসূমহকে বোম্বের বাইরে নিয়ে আসা।যাতে তারা পিএনএস গাজীর শিকারে পরিণত হয়।
*দ্বারকায় থাকা শত্রু র্যাডার ইন্সটলেশন ধ্বংস করা।
* শ্ত্রুর মনোবল নামিয়ে আনা।
*উত্তর ফ্রন্টে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ কমিয়ে আনা।

তবে পাকবাহিনী এদের অধিকাংশ অবজেক্টিভ পূরণে ব্যার্থ হয়। অবশ্য এতে যতটা না ভারতীয়দের কৃতিত্ব। তার চেয়ে ভাগ্যকে দায়ি করা যায় বেশি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে,পাক নৌবাহিনী প্রথমে তাদের ৬টি ডেস্ট্রয়ার থেকে ৫০টি করে ২.২৫ ইঞ্চি শেল নিক্ষেপ করে। তারপর ৫ মিনিট বিরতি দিয়ে,আবার আরেকদফা গোলা বর্ষণ করে। এদের বেশিরভাগই দ্বারকার লাইট হাউজ আর রেলওয়ে স্টেশনের মাঝে প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকায় গিয়ে পড়ে। কাছের একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে বেশ কিছু শেল গিয়ে পড়ায়।সেখানে আগুন ধরে যায়। সেই আগুনের ধোঁয়া ২০ কিলোমিটার দূরে থাকা পাকিস্তানি জাহাজেও দেখা যায়। ভারতীয় কতৃপক্ষের ভাষ্যমতে,দ্বারকা র্যাডার স্টেশনেও বেশ কিছু শেল পড়েছিল। তবে এতে র্যাডার স্থাপনার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। হামলার পরদিন সকালে,প্রায় ৪০টি অবিস্ফোরিত শেল উদ্ধার করে ভারতীয় সেনারা। এদের বেশিরভাগের গায়েই ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীর সিল ছিল।ধারণা করা হয়,দেশভাগের সময় এগুলো পাকিস্তানিরা হাতে পেয়েছিল। রেডিও পাকিস্তান জানায়,হামলায় দ্বারকার র্যাডার স্টেশনের বেশ ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তাদের দাবির সমর্থনে জানা যায়,দ্বারকায় হামলার পর,ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলা কিছুটা কমে আসে। সম্ভবত তাদের জন্য পর্যাপ্ত র্যাডার গাইডেন্স ছিল না। তবে,ভারতীয় প্রতিক্রিয়ায় শত্রু ইউনিটকে পিএনএস গাজীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।কারণ,সেসময় ভারতীয় নৌবাহিনীর ২৩টি জাহাজের মধ্যে ১০টিই বোম্বেতে মেরামতের জন্য পড়েছিল। দ্বারকার কাছেই ওখা বন্দরে,ভারতীয় নৌ বাহিনীর একটি ডেস্ট্রয়ার, আইএনএস তালওয়ার থাকলেও,তাকে হামলার জন্য আদেশ দেয়নি ভারতীয় হাই কমান্ড।

ভারত,পাকিস্তান উভয় দেশেই অপারেশন দ্বারকাকে খুবই গুরত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। পাক-ভারত উভয়ের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম কোনো নৌযুদ্ধ। আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তান কিছুটা সফলতা পেলেও,এই হামলায় তাদের বড় কোনো সাফল্য আসেনি। সামরিক বিজয়ের চেয়ে এখানে তাদের রাজনৈতিক বিজয় হয়েছিল। তবে ভারতীয় কতৃপক্ষের কাছে,এই হামলার প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ। হামলার পর,ভারতীয় নৌবাহিনী থেকে কোনো পালটা হামলা না করায়,জনগণ এটাকে অপমান হিসেবে ধরে নিয়েছিল। ভারতের সংসদে তখন এ নিয়ে তীব্র বাকবিতন্ডা হয়েছিল। ভারতীয় কতৃপক্ষ তাদের যুদ্ধ জাহাজগুলো তাদের নৌসীমার ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকার জন্য আদেশ দিয়েছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর তৎকালীন প্রধান,ভাইস এডমিরাল বিএস সোমান অবশ্য পালটা হামলার জন্য অনুরোধ করেন। তবে তার অনুরোধ ভারতীয় হাই কমান্ড ফিরিয়ে দেয়। ভাইস এডমিরাল এন কৃষ্ণানের মতে,হামলার সময় কাছের ওখা বন্দরে থাকা,আইএনএস তালওয়ারকে পালটা হামলার নির্দেশ ছিল,একটি কাপুরুষচিত পদক্ষেপ। পাক কতৃপক্ষের মত,দ্বারকা অপারেশনের কারণেই,ভারতীয় সরকার পরবর্তীতে প্রায় ১০০ কোটি রুপি বিশাল উন্নয়ন প্রজেক্ট হাতে নিতে বাধ্য হয়। যা আজকের হিসেবে প্রায় ২৬০ মিলিয়ন ডলার। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রথমবারের মত মিসাইল বোট সংগ্রহ করে ভারত। যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়,অপারেশন ট্রাইডেন্টে ব্যবহার করে তারা। পাকিস্তান সরকার এখনও একে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের গুরত্বপূর্ণ জয় হিসেবে দেখে।