অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ এর জীবনী

অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ‘মেহমেদ দ্য কনকুয়েরর’ হিসাবেও পরিচিত। দ্বিতীয় মেহমেদ ছিলেন সপ্তম অটোমান সুলতান এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতানদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আনাতোলিয়া এবং বলকানসের অটোমান শাসনকে একীভূত করেছিল। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ কন্সট্যান্টিনোপলের মতো মূল্যবান শহরটিকে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং তাঁর ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে রূপান্তর করেছিলেন। তাঁর বিজয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সমাপ্তি চিহ্নিত করে এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অটোমান আধিপত্যের এক নতুন যুগের সূচনা করে।
সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ১৪৩৩ সালের ৩০ শে মার্চে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের তৃতীয় পুত্র। তার মা ছিলেন বলকান বংশোদ্ভূত হুমা হাতুন। মেহমেদ শৈশবকাল এদির্নে কাটিয়েছেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে দ্বিতীয় মেহমেদ আমাসায় চলে যান এবং তার ভাই আহমেদের মৃত্যুর পর আমাসিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হন। সুলতানের সন্তান হওয়ায় শৈশব থেকেই মেহমেদ দেশের সেরা পণ্ডিতদের কাছে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি ছোট থেকেই ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস ও বিভিন্ন বিদেশী ভাষার শিক্ষালাভ করেছেন। আরব লেখক আল-কিন্দি ও ইবনে খালদুনের লেখা পড়ে মেহমেদ ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতো তিনি একদিন কনস্টান্টিনোপল জয় করবেন।
মেহমেদের পিতা, সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ তার রাজত্বের সূচনাকাল থেকেই বিভিন্ন দেশীয় ও বিদেশী দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিল। তাঁর রাজত্বের শুরুতে মুরাদ তার এক ভাইয়ের বিরুদ্ধে উত্তরাধিকার যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তার ভাই বাইজান্টাইন এবং অন্যান্য বলকান খ্রিস্টান রাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অঞ্চলে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই বিদ্রোহকে চূর্ণ করার পরে, সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ বিভিন্ন তুর্কি রাজ্য যেমন পূর্ব দিকে কারামানিদের এবং পশ্চিমের ভেনিসিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান এবং ক্রুসেডারদের মতো বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এই দীর্ঘকালীন কোন্দল ও তার প্রিয় পুত্র আলাউদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যু মুরাদকে বেশ আঘাত করেছিল এবং তিনি ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে বুরসায় অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এই সময় তিনি ১২ বছর বয়সী মেহেমেদকে অটোমান সিংহাসনে বসান।
এই অল্পবয়সী সুলতানের অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অটোমানদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিভিন্ন দেশীয় গোষ্ঠীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল প্রথম থেকেই। ১৪৪৪ খিস্টাব্দে পোপ ইউজিনে সুলতান মুরাদের সাথে করা পূর্ববর্তী শান্তিচুক্তি বাতিল করে নতুন সেনাবাহিনী সংগ্রহ করতে শুরু করে। ইতোমধ্যেই দক্ষিণ গ্রীসের একটি ছোট বাইজেন্টাইন অঞ্চলের শাসক অটোমান থেলাসিতে আক্রমণ শুরু করে। এই ঘটনাগুলি উচ্চ-পদস্থ অটোমান কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্ম দেয়। পুত্র মেহমেদের পাঠানো একটি চিঠি পেয়ে সাম্রাজ্যের এই হুমকি মোকাবেলা করতে সুলতান মুরাদ পুনরায় সিংহাসনে ফিরে আসেন। এই সময় মেহমেদ আবার তার পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। ১৪৫১ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের মৃত্যুর পর মেহমেদ আবার অটোমান সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসার পর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
কনস্টান্টিনোপল অবরোধের আগেই মেহমেদ অন্যান্য ইউরোপীয় রাজ্য ও কারামানীয়দের সাথে অটোমানদের শান্তি চুক্তি পূনর্নবীকরণ করা শুরু করেছিল। তারপর তিনি গ্যালিপোলিতে নৌবাহিনী তৈরী করতে থাকে ও থ্রেসে সৈন্য সংগ্রহ করে। ১৪৫২ সালের শীতে মেহমেদ কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করা শুরু করেন। ১৪৫২ সালেই তিনি বাইজেন্টাইন রাজধানীতে নিজের দাবী জোরদার করার জন্য রুমেলিহিসারি নামে একটি ঐতিহাসিক দূর্গ গঠন করে।
একই বছর মেহমেদ নামকরা হাঙ্গেরীয় কামান নির্মাতা আরবানসহ একাধিক অভিজাত প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবককে একত্রিত করে তাদের বিপুল পরিমাণের কামান নির্মাণের দায়িত্ব দেন। কনস্টান্টিনোপল অবরোধের শেষ দিকে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ বাইজেন্টাইনদের শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের জন্য একটি আলটিমেটাম জারি করেছিলেন। কিন্তু বাইজানটাইন সম্রাট কনস্টানটাইন একাদশ প্যালাইলোগোস এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ফলে ১৪৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কনপ্সটান্টিনোপল অবরোধের সূত্রপাত হয়। তিনটি ধাপে সুলতান মেহমেদ আক্রমণ শুরু করেছিল। প্রথম আক্রমণের নেতৃত্বে ছিল তার বাসিবজুক ও আযাপ পদাতিক বাহিনী। তারা সফল না হলেও প্রতিপক্ষদের ক্লান্ত করতে পেরেছিল। হামলার দ্বিতীয় ধাপে তারা শহরটির বাইরের রক্ষা প্রাচীরের একটা অংশে বিস্ফোরণ চালাতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে তারা দ্রুত প্রাচীরে প্রবেশ করতে পারে বাইজেন্টাইন সেনাপ্রধান জিস্টিনিয়িনি এই সংঘর্ষে মারাত্মক আহত হলে বাইজেন্টাইনরা তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং সুলতান মেহমেদের কনস্টান্টিনোপোল জয় নিশ্চিত হয়।
গাজী রীতিনীতি অনুসরণ করে অটোমান সেনাবাহিনীকে তিন দিনের জন্য শহরটি লুট করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তৃতীয় দিনের পরে, চার্চিয়াসের গেট দিয়ে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ শহরে তার বিজয়ী প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর মিছিলটি সরাসরি হাজিয়া সোফিয়ায় গিয়েছিল, যা পরবর্তীতে একটি মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। শহরে জনসংখ্যা ফিরিয়ে আনার জন্য সুলতান আনাতোলিয়া ও বলকানের সকল ধর্ম ও জাতির মানুষকে নতুন রাজধানীতে বসতি স্থাপনের আদেশ দেন। শহরের ক্ষতিগ্রস্থ অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের জন্যও সুলতান ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি একটি নতুন প্রাসাদ গড়ে তোলেন যা বর্তমানে তোপকাপি প্যালেস নামে পরিচিত।
১৪৫৩ সালের মে মাসে কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ আনাতোলিয়া এবং বলকান অঞ্চলে তুর্কী ও গ্রীক রাজ্যগুলো জয়ের দিকে মনোযগী হন। ১৪৫৬ সালে তিনি বেলগ্রেডে পৌছালেও বেলগ্রেড জয় করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু বেশ কিছু সার্বিয়ান অঞ্চলে তার রাজত্ব অব্যাহত চিল। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য চিল রোম জয় করা ও ‘নতুন রোম’ প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যে তিনি ১৪৮০ সালে ইটালি আক্রমণ করেন কিন্তু সুলতান মেহমেদ রোম জয় করার পূর্বেই মৃত্যবরণ করেন।
সুলতান মেহমেদ অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার ধর্মীয় মনোভাবের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। সুলতান নিজেই সাতটি ভাষায় কথা বলতেন এবং তিনি আটটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করেছিলেন। তিনি একজন শখের চিত্রকর্মের সংগ্রাহক ছিলেন। তিনি রেনেসাঁর প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের ব্যক্তিগত পাঠাগারে চিকিৎসা, ভূগোল, দর্শণ ও প্রাচীন ইতিহাসের অনেক বইয়ের সংগ্রহ চিল। তার শাসনামলে অটোমান সাম্রাজ্যের সিভিল ও ফৌজদারি আইনকে একটি একক আইনের আওতায় আনা হয়।
১৪৮১ সালে ইটালি জয়ের পর সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন এবং গুরতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার কিছুদিন পর ১৪৮১ সালের ৩ মে মাত্র উনপঞ্চাশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ফাতিহ মসজিদ কমপ্লেক্সে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদকে কবরস্থ করা হয়। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তার দ্বিতীয় পুত্র বায়েজিদ।
মেহমদের প্রথম স্ত্রী ছিলেন গুলবাহার হাতুন। তাদের বায়েজিদ নামে একজন পুত্রসন্তান ও গেভেরহান হাতুন নামে একজন কন্যাসন্তান ছিল। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী গালাহা হাতুন এবং তাদের মোস্তফা নামে একটি পুত্র ছিল। সুলতানের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন দুলকাদির শাসক সুলেমান বেয়ের কন্যা সিতিশা হাতুন ।১৪৫১ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ জাগান পাশার মেয়ে হেতিজা হাতুনকে বিয়ে করেন এবং তাদের ১৪৫৩ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের পঞ্চম স্ত্রী ছিলেন সিচেক হাতুন এবং তিনি সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্রের মা ।