ব্যাটেল অফ প্রেভেজা-১৫৩৮ | উসমানীয়দের কাছে খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত হলি লীগের পরাজয়

আমরা অনেকেই হালিউডের বিখ্যাত মুভি পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান দেখেছি। মুভিটির অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল এডমিরাল হেক্টর বারবারোসা। প্রতিটি পর্বে তিনি তার অনবদ্য ভূমিকায় বিশাল বাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও স্পেনের জাহাজগুলোকে ধ্বংস করে দেন। আবার একই সাথে ভয়ঙ্কর সব দস্যুদের বিরুদ্ধে নানা অভিযান পরিচালনা করেন। আবার অন্তিম মুহুর্তে তিনি বিপদে পরা জ্যাক স্প্যারোকে রক্ষাও করেন এডমিরাল বারবারোসা।
তবে প্রকৃতপক্ষে এই চরিত্রটি আসলে একজন অটোম্যান এডমিরালের নাম থেকে নেয়া। যার নাম খায়রুদ্দিন বারবারোসা। তাকে বলা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে সফল এবং অন্যতম একজন এডমিরাল। তিনি ও তার নৌবাহিনী সম্মিলিত খৃষ্টানদের নৌশক্তিকে পরাজিত করেছিলেন অসংখ্যবার। ১৫৩২ সালে পোপ ৩য় পলের আহ্বানে খৃষ্টান নৌ-বাহিনীর একটি হলি লীগ গঠিত হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অটোম্যানদের পরাজিত করে সমুদ্রে নিজেদের একক প্রভাব বিস্তার করা। কিন্তু তাদের এ আশা শেষ করে দেন এডমিরাল খায়রুদ্দিন বারবারোসা। তার নির্দেশনায় তুর্কী নৌ-বাহিনী ভুমধ্যসাগরে ইউরোপীয় বন্দরে ও জাহাজে হামলা চালিয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন। এ হামলা ইউরোপকে এতটাই বিপর্যস্থ করে দিয়েছিলো যে, তারা শেষ পর্যন্ত পোপকে অনুরোধ করতে বাধ্য হয় বারবারোসার বিরুদ্ধে একটি নৌ-ক্রুসেড ঘোষনা করার জন্য। কিন্তু ১৫৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেভেজার যুদ্ধে খৃষ্টানদের সম্মিলিত নৌ-বাহিনী বারবারোসার নিকট শোচনীয় ভাবে পরাজয় বরণ করে।
অ্যাডমিরাল হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর, হাইরেদ্দীন বারবারোসা দুই দশক ধরে উত্তর আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগর এবং পূর্ব আটলান্টিকে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেছেন। তার কয়েক ডজন রণতরী ছিলো, সেই সঙ্গে নৌ ও স্থলবাহিনীর বিশাল এক বহর। এই বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে ভূমধ্যসাগরে অটোমান প্রভাবকে পাকাপোক্ত করে তোলেন তিনি। তারপর নজর দেন দক্ষিণ ইউরোপের উপকূলবর্তী এলাকায়। আমেরিকার সঙ্গে স্পেনীয়দের বাণিজ্যিক পথগুলো একে একে বন্ধ করে দিতে থাকে তার বাহিনী। এসব নৌ অভিযান থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদও অর্জন করে তারা।
১৫৩৮ সালে পোপ তৃতীয় পল বারবারোসার বিরুদ্ধে একটি নৌ ক্রুসেডের আয়োজন করেন। পোপের নেতৃত্বে পাপাল রাজ্য, স্পেন, জেনোয়া, ভেনিস প্রজাতন্ত্র এবং মালটার নাইটদের সমন্বয়ে একটি যৌথ নৌবাহিনী গড়ে তোলা হয়। যৌথ বাহিনীর নাম দেওয়া হয় ‘পবিত্র সংঘ’। এই বাহিনীর লক্ষ্য ছিলো যেকোনো মূল্যে বারবারোসার নেতৃত্বাধীন অটোমান নৌবাহিনীকে পরাজিত করা। পোপের নৌবহরের দায়িত্ব দেওয়া হয় অ্যাডমিরাল আন্ড্রে ডরিয়ারের হাতে। এই নৌবহরে ১৫৭টি রণতরী ছিলো। অন্যদিকে বারবারোসার নেতৃত্বাধীন অটোমান বাহিনীর ছিলো ১২২টি রণতরী। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৫৩৮ সালে প্রেভায় সংঘটিত এই নৌ যুদ্ধে বারবারোসার বাহিনীর কাছে পোপের যৌথ বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
অটোমানরা যৌথ বাহিনীর ১০টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলো। এছাড়া তাদের ৩৬টি জাহাজ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং আরও ৩টি জাহাজ অটোমানদের হাতে চলে যায়। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অটোমানদের একটি জাহাজও হারাতে হয়নি। তবে তাদের ৪০০ জন সৈনিক নিহত হয় এবং প্রায় ৮০০ জন সৈনিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো। খ্রিস্টান যৌথবাহিনীর ৩,০০০ নাবিক অটোমানদের হাতে বন্দি হয়। ফলে রাত না পোহাতেই অ্যাডমিরাল আন্ড্রে ডরিয়া নিজ বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেন।
এমন চমৎকার একটি যুদ্ধ জয়ের পর, অটোমান সুলতানের তোপকাপি প্রাসাদ যেন বারবারোসাকে অভ্যর্থনা জানাতে মুখিয়ে ছিলো। তখন অটোমানের সিংহাসনে ছিলেন সুলতান সুলেইমান। তিনি বারবারোসাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাকে পুরষ্কার হিসেবে সমগ্র অটোমান নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল হিসেবে পদোন্নতি দেন। সেই সঙ্গে উত্তর আফ্রিকা এবং রোডসের প্রধান প্রশাসক হিসেবেও নিয়োগ পান বারবারোসা। পরের বছরগুলোতে বারবারোসা তিউনিস এবং ত্রিপলি অটোমান শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন।
বারবারোসার জীবনকালে তার আক্রমনের প্রধান টার্গেট ছিলো স্পেন। যখন খ্রিষ্টান রাজা ফার্দিনান্দ গ্রানাডা দখল করে গনহত্যা চালায় এবং মুসলিমদের নির্বাসন দেয়, তখন তিনি ছোট ছিলেন। কিন্তু এর প্রতিশোধের কথা তিনি কখনো ভুলে যাননি। বড় হয়ে বারবারোসা একবার স্পেনের এক বন্দরে হামলা করে প্রায় ৭০ হাজার মরিসকোকে উদ্ধার করে উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ায় নিয়ে আসেন। তার জীবদ্দশায় তিনি ও তার বাহিনী ৭ লক্ষ মুসলিমকে স্পেনের খ্রিষ্টানদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার হাত থেকে রক্ষা করেন। আন্দালুস পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি অসংখ্যবার স্পেনে হামলা করে স্পেনের নৌ-বাহিনীকে হারিয়ে এর উপকূলীয় শহরগুলো জয় করেন।
১৫৪৫ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পরলে উসমানীয় রাজধানী ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন। সেখানে কিছুদিন থেকে অস্থির হয়ে আবার জীবনের শেষ অভিযানে বের হয়ে স্পেনের নৌ-বন্দরগুলোতে হামলা চালিয়ে বোমাবর্ষন করে ফিরে আসেন। কিন্তু বিখ্যাত এই অ্যাডমিরাল আগে থেকেই আসুস্থ থাকায় ৪ জুলাই, ১৫৪৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মারা যাওয়ার খবর শুনে তখন হলি লীগের সম্মিলিত বাহিনী আনন্দ উৎসব করে ও পোপ নিজেও খুশীতে বিশেষ বানী দেন! কারণ খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে তার কোন পরাজয়ের ইতিহাস নেই। তিনি বিভিন্ন নৌ-যুদ্ধে খৃষ্টানদের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন তা ইতিহাসে আর কেউ করতে পারেনি।