বার্কে খানের জীবনী | চেঙ্গিস খানের নাতি বার্কে খান

মঙ্গোল সেনা বার্ক খান চেঙ্গিস খানের নাতি ছিলেন। বার্ক তুর্কি এবং মঙ্গোল উভয় সম্প্রদায় দ্বারা ব্যবহৃত একটি নাম। মঙ্গোলীয় ভাষায় বার্ক এসছে “বেরখ” থেকে যার আক্ষরিক অর্থ “শক্তিশালী”। বার্কে খান আসলেই একজন শক্তিশালী মঙ্গোলিয় সেনা ছিল। অন্যান্য মঙ্গোলদের মতো বার্কও অল্প বয়সে তার সামরিক কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযানে অংশ নেন কিন্তু তার কর্মজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র গোল্ডেন হোর্ড শাসন করা। তিনি ১২৫৭ সাল থেকে ১২৬৬ সাল পর্যন্ত ব্লু হোর্ড ও হোয়াইট হোর্ডের ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ব্লু হোর্ড (পশ্চিম) এর তার ভাই বাতু খানের স্থলাভিষক্ত হন এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে খানাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইলখানাতে পারস্য ভিত্তিক আরেকটি মঙ্গোল খানাতের বিরুদ্ধে গিয়ে মিশরীয় মামলুকদের সাথে মিত্রতা করেন। বার্কে টলুইড গৃহযুদ্ধে আরিফ বোককে সমর্থন করেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করেননি কারণ তিনি তার নিজের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন।
[embedyt] https://www.youtube.com/watch?v=J18lOaDwv3c[/embedyt]বার্ক চেঙ্গিস খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র জোচির সন্তান। বার্কের মা ছিলেন খোয়ারাজমের দ্বিতীয় মুহাম্মদের ধৃত কন্যা খান-সুলতান (অথবা সুলতান খাতুন)। বার্কের জন্মের বছর সম্পর্কে কোন স্পষ্ট তথ্য নেই। কিন্তু ১২৬৪ সালে মামলুকের রাষ্ট্রদূত তাকে ৫৬ বছর বয়সী বলে বর্ণনা করেন। যাইহোক, সমসাময়িক ফার্সি ইতিহাসবিদ জুজানি দাবি করেন যে ১২১৯ থেকে ১২২১ সালের মধ্যে সংঘটিত খোয়ারেজমিয়ার মঙ্গোল বিজয়ের সময় বার্কের জন্ম হয়।
১২৩৬ সালে বার্ক তার ভাই অর্দা, সিঙ্কুর, শিবান এবং বাতু খানের নেতৃত্বে একটি বিশাল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, যার মধ্যে প্রায় ১৫০,০০০ সৈন্য ছিল। এই বিশাল সেনাবাহিনী সাইবেরিয়া থেকে মিছিল করে মুসলিম ভোলগা বুলগার এবং কিপচাকদের এলাকায় প্রবেশ করে। বাতু ও সুবুতাই ককেশাসের উত্তরে বার্ককে পাঠান কিপচাকদের জয় করার জন্য। এরপর তারা ১২৩৭ সালে রায়াজান ও সুজদাল ধ্বংস করে এবং রাশিয়ায় প্রবেশ করে। ১২৩৮-৩৯ সালের শীতকালে বার্ক কিপচাকদের পরাজিত করেন এবং মারকিটসের প্রধানকে কারারুদ্ধ করেন। বার্ক তার ভাইয়ের অধীনে থেকে ইউরোপ আক্রমনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মোহি যুদ্ধে হাঙ্গেরীয় সেনাবাহিনী ধ্বংস করার সময়ও উপস্থিত ছিলেন। ওগেদির মৃত্যুর পর মোংকে খানকে নতুন গ্রেট খান নির্বাচিত করতে বাটু বার্ক খানকে মঙ্গোলিয়ায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। যখন তিনি সেখানে পৌঁছালেন তখন তিনি চাগাতাই ও ওগেদিদ পরিবারকে বেশ কয়েকবার আমন্ত্রণ জানালেন। এজন্যই বার্ক ১২৫১ সালে কুরুলতাই পরিচালনা করেন এবং মোংকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৫৫ সালে বাতু মারা যায় এবং অল্পসময়ের জন্য তার পুত্র সরতাক এবং উলাঘচি তাদের পিতার সিংহাসনে বসে। কারন ১৯৫৭ সালে বার্ক খান নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বার্ক খান একজন সক্ষম শাসক ছিলেন এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্যের পশ্চিম খানাতে গোল্ডেন হোর্ড রক্ষণাবেক্ষণ ও স্থিতিশীল করতে সক্ষম হন। তার শাসনামলে মঙ্গোলরা অবশেষে হালিচের দানিলোর বিদ্রোহকে পরাজিত করে এবং ১২৫৯ সালে জেনারেল বুরুন্দাই এর (লুবলিন, জাউইচস্ট, স্যান্ডোমিয়ারজ, ক্রাকো ও বাইটম লুণ্ঠন) নেতৃত্বে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া দ্বিতীয়বারের মতো আক্রমণ করে। এছাড়াও ১২৬৫ সালে বার্ক খানের বাহিনী বুলগেরিয়া ও বাইজেন্টাইন থ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।
১২৫২ সালে বুখারা শহরে বার্ক খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যখন তিনি সারাই-জুকেতে ছিলেন তখন এক কাফেলার সাথে বার্কের দেখা হয়। তিনি তাদের ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেন। তখন কাফেলা ভ্রমণকারীদের দ্বারা বার্ক প্রভাবিত হন। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে একজন মুসলমান হয়ে ওঠেন। এরপর বার্ক তার ভাই তুখ-তিমুরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি করান। বার্ক শীঘ্রই একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে ওঠেন। তার ধর্মান্তরের ফলে ব্লু হোর্ড প্রাথমিকভাবে মুসলিম অধ্যুষিত হয়ে ওঠে। যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ অ্যানিমিস্ট এবং বৌদ্ধ ছিল।
বাগদাদের ধ্বংসে বার্কে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং তিনি হুলাগু খানের সাথে মোকাবেলা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। হুলাগু খান খলিফা আল-মুস্তাসিমকে হত্যা করেছিলেন এবং সিরিয়া ও মিশরের প্রতি তার আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বার্কের সহযোগী মুসলমানদের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল।
ইতোমধ্যে কিটবুকার নেতৃত্বাধীন ইলখানাতদের ফিলিস্তিনের উপকূল ধরে রাখা ক্রুসেডারদের সাথে পতন ঘটে এবং মামলুকরা তাদের সাথে নিরপেক্ষতার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। মামলুকরা তাদের এলাকা দখল করে নেয় এবং আইলখানেট সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়। কিটবুকাও নিহত হয় এবং ফিলিস্তিন ও সিরিয়া পুনরুদ্ধার করা হয়। কিন্তু বার্ক এবং হুলাগুর মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ শুধু ধর্মই নয়, অঞ্চলও ছিল।
১২৬২ সালে এই দ্বন্দ্ব উন্মুক্ত যুদ্ধে পরিণত হয়। ১২৬৩ সালে ককেশাসের উত্তরে একটি আক্রমণে হুলাগু খান গুরুতর পরাজয়ের সম্মুখীন হন। বার্কের ভাগ্নে নোগাই তেরেক নদীতে হুলাগুর বাহিনীকে পিষে দেয়, যার ফলে হুলাগু পিছু হটতে বাধ্য হয়। তিনি ১২৬৫ সালে মারা যান। এছাড়াও চাগাতাই খান আলঘু খোয়ারিজম আক্রমণ করেন এবং গোল্ডেন হোর্ড জমি দখল করেন।
বার্ক এছাড়াও টলুইড গৃহযুদ্ধে গ্রেট খান দাবিদার আরিক বোকে সমর্থন করেন এবং তিনি আরিক বোকে নামে মুদ্রা ছাপায় করেন। তবে কুবলাই ১২৬৪ সালে আরিফ বোককে পরাজিত করেন।
যখন বার্ক হুলাগুর ছেলে আবাকা খানকে আক্রমণ করার জন্য কুরা নদী পার হতে চেয়েছিলেন তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১২৬৬ থেকে ১২৬৭ সালের মধ্যে মারা যান। বার্ক খানের স্থলাভিষিক্ত হন তার নাতি মেংগু-তিমুর। মামলুকদের সাথে মিত্রতার নীতি এবং ইলখানাতে নিয়ন্ত্রণ মেংগু-তিমুর অব্যাহত রেখেছিল। অনেক ঐতিহাসিক একমত যে হুলাগুর বিরুদ্ধে বার্কের পদক্ষেপ মক্কা ও জেরুজালেম সহ অন্যান্য পবিত্র ভূমিকে বাগদাদের মত একই পরিণাম থেকে রক্ষা করেছে।
লেখক – আনিকা আফিয়া জাহান নদী ( নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily )