একজন ব্যারিস্টার রফিক-উল হ্ক এবং তার অজানা কথা

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা আইনজীবী । যিনি ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন অন্যতম জ্যেষ্ঠ ও প্রবীনতম আইনজীবী এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল । শুধুমাত্র আইন পেশার সীমানায়ই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি বরং তিনি ছিলেন খুবই দানশীল প্রকৃতির একজন মানুষ এবং আদ-দীন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসিবেও তিনি দয়িত্ব পালন করেছেন । নিজস্ব অর্থায়নে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য তিনি অসংখ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন । অ্যাটর্নি জেনারেল হিসিবে যখন দায়িত্বরত ছিলেন তখন তিনি সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বেতন ভাতা গ্রহণ করেন নি । তিনিই একমাত্র আইনজীবী যিনি একই সাথে বাংলাদেশের চির বৈরি দুই রাজনৈতিক দলের নেতা শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনি লড়াই লড়ে ওয়ান/ইলাভেনের সময় তাদের মুক্ত করেন । জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী তার দীর্ঘ জীবনে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন, তিনি কালের আবর্তে একাধারে ব্রিটিশ ভারত, পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নাগরিক হন ।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ১৯৩৫ সালে ২ নভেম্বর কলকাতাস্থ সুবর্ণপুর নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন । তার বাব হচ্ছেন মুমিন-উল হক যিনি ছিলেন চিকিৎক এবং মা হচ্ছেন নূরজাহান বেগম।তার শৈশব কেটেছে কলকাতাতেই সেখানে তিনি চেতলা স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন । স্কুল কলেজের গণ্ডি পেড়িয়ে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেখান থেকে ১৯৫৫ সালে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতোকত্তর এবং এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৫৮ সালে । এলএলবি সম্পন্ন করে প্রাথমিকভাবে তিনি কলকাতাতেই আইন পেশায় নিয়োজিত হন । উচ্চশিক্ষার জন্য পারি জমান যুক্তরাজ্যে সেখানে তিনি ১৯৬১ বার অ্যাট ল সম্পন্ন করেন, এরপর ডাক পান লন্ডনের লিঙ্কস ইনে কিন্তু উন্নত জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে দেশের টানে ফিরে আসেন । দেশে ফেরার পর তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে পুনরায় তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসাবে তালিকাভুক্ত হন । ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন । ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।এসময় তিনি সরকারের পক্ষ থেকে কোনরূপ বেতন ভাতা গ্রহণ করেন নি ।
১/১১ এর সময় দেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে কোন রূপ পেমেন্ট ছাড়াই দুই নেত্রীকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই করে তাদের মুক্ত করতে সক্ষম হন । যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ আইনজীবী নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেকোন এক দলের তাবেদার হিসেব নিজেকে নিযুক্ত করতে সবাচ্ছন্দবোধ করেন সেখানে তিনি ছিলেন একেবারেই ব্যাতিক্রম ।
১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘ ৬০ বছরের উকালতি পেশায় সততাই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন ।
ব্যারিস্টার রফিকুল হক ১৯৬০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাঁরা স্ত্রী হচ্ছেন ফরিদা হক যিনি পেশায় একজন ডাক্তার । ডাক্তার ফরিদা হক বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত নির্মূলে বিশেষ ভূমিকা পালন করায় তাকে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার পক্ষ থেকে স্বর্ণ পদক প্রদান করা হয় । এই দম্পতির একজন ছেল সন্তান রয়েছে, যিনি হচ্ছেন ব্যারিস্টার ফাহিমুল হক তিনি নিজে এবং তার স্ত্রীও আইন পেশায় নিয়োজিত ।
ব্যারিস্টার রফিক উল আইন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের জন্য সদা কর্মতৎপর ছিলেন । তার একান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন বেশ কিছু হাসপাতাল,এতিমখান মেডিক্যাল কলেজ । ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ফারমগেটের ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদ দাদা । ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য লটারি বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা ছাড়াও এর প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি । বারডেম হাসপাতালে মাইক্রোবায়লোজি ডিপার্টমেন্ট ও নূরজাহান ওয়ার্ড খুলতেও তিনি বিশেষ সহায়তা করেন । তারই একান্ত প্রচেষ্টা এবং তার নিজস্ব অর্থায়নে ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈরে একটি একশত শয্যার সুবর্ণ-ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন যে হাসপাতাল নির্মাণাধীন রয়েছে । এছাড়াও আহ্সানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল,সুবর্ণ ক্লিনিক এর প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে তার অবদান । আদ-দীন মেডিক্যাল কলেজের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ।
কিছু দিন আগে তার স্ত্রী মৃত্যু বরণ করেন । ব্যারিস্টার রফিকুল হক নিজেও এক সময় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে চিকিৎসার মাধ্যেমে সুস্থতা অর্জন করেন, যে কারণে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্ন্যয়ন কল্পে সবসময় নিয়োজিত রেখেছিলেন । সর্বশেষ তিনি বার্ধক্য জনিত নানা সমস্যায় জর্জরিত চিকিৎসকের সম্রনাপ্নন হন এবং আদ-দীন মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন ।
লেখক : ইসমাইল সরকার ( নিয়মিত লেখক AFB Daily )