তুরস্ক বনাম গ্রীস যুদ্ধ ১৯১৯ –১৯২২ | তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা জাতীয় আন্দোলন তুর্কি জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং মিত্রশক্তির পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘটিত হয়। এসময় তুরস্কের পশ্চিমে গ্রীকদের সাথে, পূর্বে আর্মেনিয়ার সাথে, দক্ষিণে ফরাসিদের সাথে এবং কন্সট্যান্টিনোপলে ব্রিটেন ও ইটালির সাথে তুরস্কের লড়াই হয়।
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগেকার কথা। সময়ের হিসেবে ১৯১৯ এর মে থেকে ১৯২৩ এর জুলাই। এই সময় সংঘটিত হয়েছিলো তুরস্কের জাতীয় আন্দোলন বা তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
আনাতোলিয়ায় মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি গঠিত হওয়ার পর তুর্কি জাতীয় আন্দোলন উৎপত্তি লাভ করে। তুরস্কের জাতীয় আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় গ্রেকো টার্কিস যুদ্ধ বা গ্রিক-তুর্কি যুদ্ধ সম্পর্কে জানবো আজকের এই ভিডিওতে। এই গ্রেকো-টার্কিশ যুদ্ধের সময়কাল ১৯১৯ এর মে থেকে ১৯২২ এর অক্টোবর পর্যন্ত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সারাবিশ্বে এক থমথমে পরিস্থিতি। বিজয়ী এবং বিজিত পক্ষের মধ্যে চলছে নানা দরকষাকষি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ছিলো জার্মানির পক্ষে। যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ঘটলে মিত্র বাহিনী তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের ভাগ বটোয়ারা করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে উৎসুক ছিলো ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ গ্রীসকে আশ্বাস দেন যে গ্রীকরা যদি তুরস্ক আক্রমণ করে তাহলে তাদের পুরাতন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের আনাতোলিয়া এলাকা গ্রীকদেরকে দিয়ে দেয়া হবে। এই আনাতোলিয়া অটোমানদের দখলের পূর্বে প্রাচীন গ্রিসের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী এলেফথেরিওস ভেনিজেলোস এই শর্তে তুরস্ক আক্রমনে রাজী হয়।
১৯১৯ সালের ১৫ই মে ব্রিটিশদের আশ্বাসে গ্রিস তুরস্ক আক্রমন করে বসে। গ্রিকরা প্রথমে তুরস্কের ইজমিরে অবতরণ করে এবং আনাতোলিয়ার উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাংশে দখলে নিয়ে নেয়। তাদেরকে সহযোগিতা করে স্থানীয় গ্রিক, আর্মেনিয়ান ও আসিরিয়ান সম্প্রদায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে তৎকালীন ইজমিরে প্রায় 30 শতাংশ মানুষ ছিল গ্রীক। তাই তারা এখানে গ্রিকদের সহায়তা করে। এই ঘটনার পরে তুরস্কে মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কি জাতীয় আন্দোলন এর সৃষ্টি হয়। একই সময়ে গ্রিসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে এলেফথেরিওস ভেনিজেলোস হেরে যায় এবং ক্ষমতায় আসে প্রথম কন্সট্যান্টাইন। এর ফলে মিত্র শক্তির দেশগুলো গ্রিসকে সহায়তা করা বন্ধ করে দেয়ার একটি সুযোগ পায়। কারণ তাদের চুক্তি ছিল গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী এনেস্থেলিওস এর সাথে। ফলে তারা ভাবে যুদ্ধে গ্রিস বিজয়ী হলেও গ্রিসকে পরবর্তীতে পরাজিত করে আনাতোলিয়া হাতিয়ে নেয়া যাবে। মিত্রশক্তির দেশগুলোর এইরকম বিশ্বাসঘাতকতা সত্বেও গ্রিক রাজা কন্সট্যানটাইন তাদের পুরনো এলাকা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। গ্রীক বাহিনী ধীরে ধীরে মানিসা, বালিকেসির, আইদিন, কুতাহিয়া, বুসরা, এবং এস্কিসেহির দখল করে এবং আরও সামনে আগাতে থাকে। তাদের এই অগ্রযাত্রা ১৯২১ সালে সাকারিয়ার যুদ্ধে ঠেকানো সম্ভব হয়। তিন সপ্তাহের এ সাকারিয়ার যুদ্ধে দুই পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। একদিকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি অন্যদিকে ব্রিটেনসহ মিত্রদেশগুলোর বিরূপ আচরনের ফলে যুদ্ধের প্রথমদিকের অগ্রগতি সত্বেও গ্রিকরা কিছু অঞ্চল তুর্কিদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
গ্রিকদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নেয় তুর্কিরা। তারা এবার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়ার সময় পায়। তুর্কিরা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সময় নেয় প্রায় ১ বছর। প্রায় ১ বছর পর মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুর্কিরা ১৯২২ সালের ২২শে আগস্ট গ্রিক সৈন্যদের পালটা আক্রমন করে। এই আক্রমনে গ্রিকরা সহজেই পর্যুদস্ত হয় এবং পলায়ন করে।
যুদ্ধে হার স্বরূপ, গ্রিকরা তুরস্কের সকল দাবী মানতে বাধ্য হয় এবং যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানায় ফিরে আসে। এতে করে পূর্ব থ্রেস এবং ওয়েস্টার্ন আনাতোলিয়া অঞ্চল তুরস্ককে ছেড়ে দিতে হয়। অপরদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রদেশ সমূহ তুর্কি জাতীয় আন্দোলনর বলীয়ান শক্তি দেখে পুরোতন সেভ্রেস চুক্তি পরিবর্তন করে লুজান চুক্তি সাক্ষর করতে সম্মত হয়।
তবে যুদ্ধের সবচেয়ে হৃদয় বিদারক অংশ হচ্ছে গ্রিকদের সাহায্য করা গ্রিক, আর্মেনিয়ান, আসেরিয়ান সম্প্রদায়কে নিয়ে। যুদ্ধে হারার পর পালিয়ে যাবার সময় গ্রিকরা ইজমির শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়। ইজমিরের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ তখন গ্রিক ছিলো। তাই তাদের এই আচরন তাদের স্বজাতির জন্যই কাল হয়ে দাঁড়ায়। তুর্কি এবং গ্রিক মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক মানুষ এই আগুনে পুড়ে মারা যায়। আর গ্রিকদের সাহায্য করার জন্য যুদ্ধের শেষ দিকে তুর্কিরাও এই ইজমিরের গ্রিক, আর্মেনিয়ান ও আসিরিয়ান দের ওপর নির্মন অত্যাচার চালায়। সবশেষে ১৯২২ এর অক্টোবরে শেষ হয় গ্রেকো-টার্কিশ যুদ্ধ বা তুর্কি-গ্রিক যুদ্ধ।
১৯২২ এ গ্রেকো-টার্কিশ যুদ্ধ শেষ হলেও তুরস্কের জাতীয় আন্দোলন শেষ হতে আরো এক বছর সময় লাগে। তুর্কি-আর্মেনীয়, ফরাসি-তুর্কি এবং আজকের ভিডিওতে উল্লিখিত গ্রিক-তুর্কি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেভ্রেস চুক্তি বাতিল করা হলে ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে লুসানের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মিত্রশক্তি আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রেস ত্যাগ করে এবং কামাল আতাতুর্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি তুর্কি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়।
তুর্কি জাতীয় আন্দোলন প্রতিষ্ঠা, উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভাগ ও উসমানীয় সালতানাতের বিলুপ্তির পর উসমানীয় যুগ ও সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে এবং ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুর্কি প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়, স্বীকৃতি পায় কামাল আতাতুর্ক পাশার আধুনিক তুরস্ক বা সেকুলার তুরস্ক, সাম্রাজ্যের স্থলে নতুন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একইসাথে বিলুপ্তি ঘটে হযরত আবু বকর (র) এর সময় থেকে সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা খিলাফতের।