চীন – ভারত যুদ্ধ- ১৯৬২ এর ইতিহাস | ভারতের চরম পরাজয় !

আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর পূর্বে ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর যেখানে পুরো বিশ্ব কিউবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত পারমাণবিক অবস্থান সম্পর্কে দৃঢ়ভাবে স্থির এবং আতঙ্কিত সেখানে চীন আক্রমণ করলো ভারতকে। তিব্বত নিয়ে আঞ্চলিক বিরোধ এবং উত্তেজনার ফলে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো।
পরবর্তী তে বিজয়ী হয় উঠে চীন। তবে সেই যুদ্ধের ক্ষোভ এখনও ভুলতে পারেনি ভারত। এই যুদ্ধই চীন-ভারত সম্পর্কের উপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে সেই যুদ্ধের জের ধরেই এখনও হয়ে চলছে রেশারেশি।বছরের পর বছর চীন – ইন্ডিয়া সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও তিনটি মূল উপায় প্রভাবিত করে চলেছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। আর তাই পান থেকে চুন খসলেই যেনো শুরু হবে মহাজঞ্জাল।
তাহলে চলুন আর দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক কি ছিলো এই যুদ্ধের চিঙ্গারী।
কিভাবে জ্বলে উঠলো চীন ভারত যুদ্ধ?
তৎকালীন ভারত কখনো ভেবেই উঠতে পারেনি যে চীন তাদের উপর আক্রমণ করবে। আর তাই ভারতের এই ভাবনার সুযোগ নিয়েই ১৯৬২ সালের ২০ ই অক্টোবর সংগঠিত হয়ে ছিলো চীন – ভারত যুদ্ধ। হঠাৎ করেই চীনের এমন আক্রমণের শিকার হওয়া তে ভারতের যুদ্ধের মূল কার্যক্রম গুলো ছিলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন । ফলশ্রুতিতে চীনের আশি হাজার সৈন্যের সাথে লড়াই করছিলো মাত্র দশ থেকে বিশ হাজার ভারতীয় সৈন্য।
১৯৪৯ সালে ভারত প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (পিআরসি) গঠনের সাথে সাথে, ভারত সরকারের জন্য অন্যতম নীতি ছিল চীনের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। চীন যখন ঘোষণা করেছিল যে, তারা তিব্বত দখল করবে, তখন ভারত তিব্বত ইস্যুতে আলোচনার প্রস্তাবের জন্য প্রতিবাদের চিঠি পাঠিয়েছিল। অন্য কোনও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের চেয়ে চীন আক্সাই চিন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করতে আরও সক্রিয় ছিল।
কিন্তু চীনের সাথে ভারত তার সম্পর্ক নিয়ে এতটা আন্তরিক ছিল যে, জাপানের সাথে শান্তিচুক্তি সমাপ্তির জন্য একটি সম্মেলনে তারা অংশ নেয়নি কারণ সেখানে চীনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমনকি চীনকে বিভিন্ন বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরে ও বিশ্বের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে চীনের প্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করেছিল ভারত।
১৯৫৪ সালে চীন ও ভারত শান্তিময় সহাবস্থানের পাঁচটি নীতিমালা অবলম্বন করেছিল, যার অধীনে ভারত তিব্বতে চীনা শাসনের স্বীকৃতি দেয়। এই সময়টি ছিল যখন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জহুরলাল নেহেরু “হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই” স্লোগান প্রচার করেছিলেন।
১৯৫৪ সালের জুলাইয়ে নেহেরু সমস্ত সীমান্তে সুনির্দিষ্ট সীমানা দেখানোর জন্য ভারতের মানচিত্রে সংশোধন পরিচালনার একটি মেমো লিখেছিলেন; তবে, চীনা মানচিত্রগুলি ভারতীয় হিসাবে প্রায় ১২০০০০ হাজার বর্গকিলোমিটারকে চীনা হিসাবে দেখিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চিউ এন্লাই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন যে, মানচিত্রে কোনও ত্রুটি ছিল।
১৯৫৯ সালের অক্টোবরে কংকা পাসে দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল এর ফলে ভারত বুঝতে পেরেছিল তারা যুদ্ধের জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। কারণ এই যুদ্ধে ভারতের মোট নয় জন পুলিশ নিহত হয়েছিল।
১৯৬২ সালের গ্রীষ্মে ভারত ও চীনের মধ্যে বিভিন্ন কোন্দল এবং সামরিক ঘটনা উদ্দীপ্ত হয়েছিল। ফলশ্রতিতে একই সালের ১০ ই জুলাই প্রায় ৩৫০ জন চীনা সেনা চুষুলের একটি ভারতীয় চৌকোকে ঘিরে ফেলে এবং গুরুখাদের বোঝাতে লাউডস্পিকার ব্যবহার করে যে তারা যেন ভারতের পক্ষে লড়াই না করে।
কিন্তু চীন যে আসল অর্থে অভ্যন্তরীণ ভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছিলো ততদিনে ও ভারত তা বুঝে উঠতে পারেনি।
১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের মূল বিষয়গুলি
১৯৬২ সালের ২০ শে অক্টোবর রাতে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি লাদাখে এবং তৎকালীন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত সংস্থার ম্যাকমাহন লাইন পেরিয়ে ভারতে আক্রমণ করেছিল।
যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত ভারতীয় পক্ষ মনে করেছিল যে যুদ্ধ শুরু হবে না এবং সামান্য প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ হবেনা এই চিন্তা করেই, ভারত দ্বন্দ্বের অঞ্চলে সেনাবাহিনীর মাত্র দুটি বিভাগ মোতায়েন করেছিলো, যখন চীনা সেনাদের তিনটি রেজিমেন্ট মোতায়েন ছিল।
আর প্রথম দিন, চিনা পদাতিক সৈন্যবাহিনী পেছন থেকে আক্রমণ শুরু করেছিল।এমতাবস্থায় চীনারা ভারতীয় টেলিফোন লাইনও কেটে দেয় এবং রক্ষকদের তাদের সদর দফতরের সাথে যোগাযোগ করতে বাধা দেয়। ফলে অবিচ্ছিন্ন ক্ষতি ভারতীয় সেনাদের ভুটানে পালাতে বাধ্য করেছিল।
তাৎক্ষণিক ভাবে ভারতীয় সেনারা যখন জানতে পেল যে একটি চীনা বাহিনী একটি পাসে জড়ো হয়েছে তখন তারা মর্টার এবং মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়ে প্রায় ২০০ চীনা সেনাকে হত্যা করেছিলো।
সেই সময়ে যখন এই খবর পাওয়া গেলো এবং অনুধাবন করা গেলো যে এই আক্রমণ পুরো দেশে ছড়াতে পারে ; ভারতের উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত তেজপুরের স্টেট ব্যাংকের ম্যানেজার ব্যাংকের সব নোট এনে জ্বালিয়ে দিলো কিন্তু পয়সা যেহেতু পড়ানো সম্ভব না তাই সেগুলো শহরের মাঝখানে একটি ঝিলে ফেলে দেয়া হলো যাতে করে এগুলো চিনিদের হাতে পৌঁছাতে না পারে।
শুধু তাই নয় ভারতের তেজপুর অঞ্চলে বসবাসরত মানুষ পালাতে শুরু করলেন এটা ভেবে যে শীগ্রই চীন তাদের অঞ্চলে হামলা করবে। এমতাবস্থায় তৎকালীন সময়ের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন , ” আসামের দরজায় শত্রু পক্ষ হামলা করতে শুরু করেছে এর ফলে আসামের ভাই বোনদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে । আর আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই ভোগান্তি হয়তো পুরো দেশকেই পোহাতে হবে। ”
অর্থাৎ তার এই ভাষণ সমগ্র ভারতবর্ষের জন্যেই ছিলো একপ্রকার সচেতন বার্তা স্বরূপ শুধুমাত্র আসামের জন্যে নয়।
যুদ্ধের দুদিনের মধ্যেই ভারত বুঝতে পারলো যে তাদের সামরিক ক্ষমতা যুদ্ধের জন্যে পর্যাপ্ত নয় এবং তখনই প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ঘোষণা দিলেন যে, “ভাই ও বোনেরা আমরা এতদিন চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছি কিন্তু তারা সেটি চায়নি। তারা আমাদের হুমকি দিয়েছিল এবং এখন তারা সে হুমকি বাস্তবায়ন করছে। তাই এখন সময় এসে গেছে আমাদের রুখে দাড়াতে হবে ।”
আর দেখতে দেখতে ভারতের এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্তে লাদাখের চিশুল অঙ্গরাজ্যের রিজাংলা এবং পূর্বাংশের নাফা এবং আসামের অরুণাচল প্রদেশ অন্তর্গত ভম্বিলা পর্যন্ত চীন তাদের দখলে নিয়ে নিলো।
ভারতীয় সৈন্যরা ছিন্ন বিচ্ছন্ন হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টার পরে ও তারা চীনের সাথে টিকে থাকতে পারলো না।
আর তাই যুদ্ধের তৃতীয় দিন প্রধানমন্ত্রী জহুরলাল নেহেরু ঘোষণা দিলেন, “আমাদের হাত থেকে অনেকাংশ জায়গা ছুটে গেছে। খুব দুঃখ হলো এটা জেনে যে আমাদের সেনাদের এক সময় সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছে। তার মানে এই যুদ্ধের আমাদের এখন চালিয়ে যেতে হবে। অল্প দিনের জন্যে না , দীর্ঘ দিনের জন্যে। মাসখানেক না বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে হবে। আর এর মধ্যে যখন কোথাও হেরে যাব সেখান থেকে আরো বেশি শক্তি নিয়ে আবার লড়াই এর জন্যে প্রস্তুত হবো।”
কিন্তু আফসোস চীন ভারতকে পুনরায় যুদ্ধ করার কোনো সুযোগ ই দিলো না। চীন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে দিলো এখানেই । এরই মধ্যে চীনের একক সিদ্ধান্তেই যুদ্ধ শুরু এবং শেষ তো হলো। কিন্তু যুদ্ধের ক্ষত ভারতের গায়ে অনন্তকালের জন্যে দাগ কেটে গেলো।
চীন ভারতের ৪২,৭৩৫ বর্গকিলোমিটার জমি দখল করে নিয়েছিলো। এই জমির পরিমাণ এতই বেশি ছিলো যে এর মধ্যে, ভারতের রাজ ধানী দিল্লির মতো ২৮ টি শহর হতে তৈরী হতে পারতো।
শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধে ১৩৮৩ ভারতীয় সৈন্য শহীদ হোন এবং ১০৪৭ জন সৈনিক গুরুতর ভাবে আহত হোন। নিখোঁজ ছিলো অন্তত ১৬৯৬ জন সৈনিক। এমনকি ৪০০০ সৈন্য সামন্ত কে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বন্ধী হতে হয়েছিল চীনের কারাগারে।
যুদ্ধের প্রায় পঞ্চাশোর্ধ বয়স পার হলে ও যেখানে ঘা এখনও সেরে উঠতে পারেনি ভারত। সেখানে দু দেশের মধ্যে এখনও নতুন আঙ্গিকে যুদ্ধ বিদ্যমান।
বর্তমান ভারত-চীন উত্তেজনার উৎস কী ?
বর্তমান বিশ্ব জুড়েই আবার ও গোলটেবিলে কথোপকথনের নতুন বিষয় হয়ে উঠেছে চীন – ভারত সংঘর্ষ।
ভারত ও চীন ২,২০০ মাইল সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে, এর বেশিরভাগ অংশ প্রত্যন্ত, পার্বত্য অঞ্চল অতিক্রম করে। অনেক ক্ষেত্রে, সীমান্ত ব্যাখ্যার বিষয় হিসাবে রয়ে গেছে, উভয় দেশই প্রতিযোগিতামূলক আঞ্চলিক দাবি করে। কয়েক দশক ধরে, দুটি দেশ শান্তিপূর্ণভাবে লাইন অব প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ হিসাবে পরিচিত – এই বিতর্কিত সীমান্তে বিস্তীর্ণতা নিষ্পত্তি করতে শান্তিপূর্ণভাবে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।
তবে মে মাসের পর থেকে চীনা সেনারা লাদাখে ভারতের দাবি করা অঞ্চলটিতে শিবির স্থাপন করেছে। গত মে মাসে, ভারতীয় ও চীনা সেনারা লাদাখ এবং কয়েকশ মাইল দূরে সিকিমের একটি অঞ্চলে শারীরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল, আহত হয় ছিলো দু পক্ষের বেশ কয়েকজন সৈনিক।
মে মাসের পার হতে না হতেই আবার যুদ্ধের শঙ্খ বাজলো।এর পরেই জুন মাসের মাঝামাঝিতে আবার এই অনাকাঙ্খিত যুদ্ধ সংগঠিত হলো। ধারণা করা হচ্ছে, লাদাখের গ্যালওয়ান উপত্যকায় রাতের অন্ধকারে চীনা সেনাদের সাথে ভয়াবহ সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন।এমনকি এটি ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের পারমাণবিক-সশস্ত্র প্রতিবেশীদের মধ্যে মারাত্মক সংঘাত ছিল এটি। একটি গণমাধ্যম প্রাণের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতীয় এক সেনা কর্মকর্তা জানান, এই যুদ্ধে কোনো অস্র নিক্ষেপ করা হয়নি এবং তার নিজের পরিচয় দিতে বা কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এইবিষয়ে কিছু প্রকাশ করার অনুমতি তার নেই।
ইতিহাসের শুরুতে লক্ষ করলেই উপলব্ধি করা যায়, প্রতিহিংসা থেকেই এই যুদ্ধ সংঘর্ষের শুরু।যুদ্ধ সংঘাত এ দুপক্ষে লেগেই থাকবে যতদিন পর্যন্ত না প্রতিহিংসা ধ্বংস হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটাই যে করোনা নামক এই মহামারী ও এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত শূন্য করতে পারলো না। তাই আমাদের উচিত নিজেদের মধ্যে ভাতৃত্ব বজায় রেখে পুরো বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদাহরণ দেয়া ।
লিখেছেন : মেহেরুন নেসা তন্বী ( নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily )
তথ্য সূত্র :