শাহজাহান সিরাজের জীবনী |যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খলিফা !

বাংলাদেশের একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন শাহজাহান সিরাজ।ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে বঙ্গবন্ধুর সহচর্যে দায়িত্ব পালন করেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে । ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ পল্টনের এক বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন শাহ জাহান সিরাজ এবং সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ছাত্র রাজনীতির কান্ডারী হিসেবে ছাত্রলীগের যে চারজন নেতাকে বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা বালা হত তাদের একজন ছিলেন এই শাহ জাহানা সিরাজ । প্রথম জীবনী ছাত্রলীগ করলেও পরে জাসদ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং সর্বশেষ বিএনপির রাজনীতিতে যোগদান করেন । বিএনপি ক্ষমতায় থাকা কালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি ।

শাহজাহান সিরাজ টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতিতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ । তাঁর বাবা হচ্ছেন আব্দুল গণি মিয়া এবং মা হচ্ছেন রহিমা বেগম । ছাত্র জীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন । টাঙ্গাইলের করটিইয়া সা’দাত কলেজে অধ্যয়ন কালে সম্পৃক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে । করটিয়া সা’দাত কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি হিসবে দুই মেয়াদে ১৯৬৪-৬৫ এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে নির্বাচিত হন তিনি । এর পর তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতেও একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসবে আবির্ভূত হন তিনি । বাঙ্গালী জাতির স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । রাজনৈতিক জীবনের পরিক্রমায় সান্নিধ্যে আসেন বঙ্গবন্ধুর এবং ১৯৭০-৭২ সালে অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি । ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসিবে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যাদের চার খলিফা উপাধি দেয়া হয়েছিল তাদের অন্যতম ছিলেন শাহজাহান সিরাজ । স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি এছাড়াও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ তথা নিউক্লিয়াসের সক্রিয় কর্মী ছিলেন । প্রথম জীবনে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল গঠন করে নতুন রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন । তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে বিএনপির সাথে যোগদান করেন তিনি । জাসদের হয়ে তিনি তিন বার টাঙ্গাইল- ৪ আসন তথা কালিহাতি থেকে নির্বাচিত হন এবং বিএনপি তে যোগদান করে একই আসনে একবার নির্বাচিত হন তিনি । ২০০১ সালে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন,সেই সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তিনি ।

শাহজাহান সিরাজ বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী থাকাকালে ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন এবং তাঁর সময়েই টু স্ট্রোক অটোরিক্সা তথা বেবি ট্যাক্সি নিষিদ্ধ করা হয় নগরাঞ্চলে ।
তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বেশ কয়েকবার জেলও খাটতে হয়েছে তাকে । প্রথম বার জাসদ গঠন করে সহ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তাকে কিছুদিন জেলে থাকতে হয়েছিল । এরপর সর্বশেষ তাকে জেলে যেতে হয় ২০০৭ সালের সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে । দুর্নীতির অভিযোগে শাহজাহান সিরাজ এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে গ্রেফতার করে জেলে নেয়া হয় । পরে অবশ্য কিছুদিন জেলে থাকার পর মুক্তি পান তিনি । কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আর আগের মত রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেন নি ।
ব্যাক্তিগত জীবনে শাহজাহান সিরাজ ছিলেন বিবাহিত । তাঁর স্ত্রীর নাম হচ্ছে রাবেয়া সিরাজ, যিনি নিজেও একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এমনকি এই দম্পতি এক সময় একে-অপরের রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন । রাজনীতির পাশা-পাশি রাবেয়া সিরাজ একজন শিক্ষিকা । এই দম্পতির এক ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছে যাদের নাম হচ্ছে- ছেলে রাজীব সিরাজ এবং দুই মেয়ে সারওয়াত সিরাজ ও শুক্লা সিরাজ ।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি এবং বাসা আর হাসপাতালে যাতায়াতের মধ্যেই তাঁর জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে । প্রথমে ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়লেও পরে আবার ব্রেইন ক্যান্সারও ধারা পড়ে তাঁর । এর পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি সমস্যাও ছিল আগে থেকেই । জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়েছেন গুলশানের একটি বাড়িতে, সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই ২০২০ সালে রাজধানী ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন তিনি ।
লেখক- ইসমাইল সরকার ( নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর- AFB Daily )