হায়া সোফিয়ার ইতিহাস | গির্জা, মসজিদ নাকি জাদুঘর ?

হায়া সোফিয়া বা হাগিয়া সোফিয়া গির্জা-মসজিদ- জাদুঘর এবং পুনরায় মসজিদ আর এই পরিক্রমায় যুগের পর যুগ আলোচনায় রয়েছে হায়া সোফিয়া । হায়া সোফিয়ার ইতিহাস জানলে খুলতে পারে এর বিবর্তন জটের রহস্য । সম্প্রতি তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালত এই হায়া সুফিয়াকে পুনরায় মসজিদ হিসেবে ব্যাবহারের অনুমতি দেয়ায় সারা বিশ্বে এটি আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ।
হায়া সোফিয়া নির্মাণের ইতিহাস
প্রায় ১৫০০ বছর আগে হায়া সোফিয়াকে মূলত একটি গির্জা হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল । বাইজেন্টাইন সম্রাট কন্সটান্টিয়াস ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে এই ঐতিহাসিক গির্জাটি প্রথম নির্মাণ করেন । প্রাথমিক নির্মাণের পর বেশ কয়েকবার এর পুনঃনির্মাণ এবং সংস্কার করা হয় । ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে আগুন লেগে এর ছাদ পুড়ে যায়, এরপর ৪১৫ সালে সম্রাট থিওডোসিওস এটি নতুনভাবে তৈরি করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এক শতাব্দী পর এটি আবার আগুন লেগে একেবারে ছাই হয়ে যায় । সর্বশেষ ৫৩২ সালে আধুনিক নির্মাণশৈলী ব্যবহার করে সম্রাট জাস্টিয়ান এটি নির্মাণ করেন, যা অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান আছে । তবে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীনে আসার একে মসজিদে রূপান্তর করা হয় এবং সংস্কার করা হয় । সম্রাট জাস্টিয়ানের নির্মাণের পর এই হায়া সোফিয়াই প্রায় ১০০০ বছর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জার রেকর্ডের অধিকারী ছিল ।
হায়া সোফিয়ার বিবর্তনের ইতিহাস
হায়া সোফিয়া মুসলিমদের মসজিদে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বেও বেশ কয়েকবার এর স্বরূপ বদলেছে । প্রাথমিক ভাবে এটি অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে নির্মাণ করা হয় এবং ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এটি অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে ব্যবহার হয়েছে কিন্তু ১২০৪ সালে একে ক্যাথলিক গির্জায় রুপান্তর করা হয় । ১২৬১ সালে পুনরায় একে অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তর করা হয় এবং তা বিদ্যমান ছিল ১৪৫৩ পর্যন্ত । ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে পদানত হয় এবং অটোম্যান সম্রাট ফাতিহ্ সুলতান মেহমেদ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর এর নাম রাখেন ইস্তাম্বুল, সেই সাথে হায়া সুফিয়াকে সংস্কার করে একে মসজিদে রূপান্তর করেন । সে সময় সময় হায়া সোফিয়ার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “ইম্পিরিয়াল মসজিদ” এবং এটি ৫০০ বছর পর্যন্ত তাঁর এর অবস্থান ধরে রাখে । ১৬১৬ সালে তুরস্কের প্রধান মসজিদ ব্লু মসজিদ নির্মাণ করার আগ পর্যন্ত এই হায়া সোফিয়া তথা ইম্পিরিয়াল মসজিদই ছিল তুরস্কের প্রধান মসজিদ ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোম্যান সালতানাতের প্রদীপ নিভে যায় এবং তুরস্কে ইসলামী ভাবধারার পরিবর্তে ইউরোপীয় আধুনিক মনস্কা এবং জাতীয়তাবাদী নেতা কামাল আতাতুর্কের উত্থান হয় । যাকে বলা হয় আধুনিক তুরস্কের জনক এবং ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান । কামাল আতাতুর্ক তাঁর শাসনামলে একটি ডিক্রি জারির মাধ্যমে ১৯৩৪ সালে হায়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তর করে । সেই সাথে নতুন আইন জারি করা হয় যে হায়া সোফিয়ার প্রধান কক্ষ বা হল রুমে কোনো প্রকার ধর্মীয় উপাসনা কর দন্ডনীয় অপরাধ, হোক সে মুসলিম অথবা খ্রিষ্টান । তবে এই জাদুঘরের কর্মচারীদের জন্য আলাদাভাবে খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের উপাসনার স্থানের ব্যাবস্থা করে দেয়া হয় । এরপর এটি সর্বসাধারণের ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং এটি তুরস্কের ভ্রমণকারীদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পটে পরিণত হয় । প্রত্যেক বছর লাখ-লাখ মানুষ এটি পরিদর্শন করতে আসে, গত বছরও প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন লোক এটি ভ্রমণ করেছে ।
হায়া সোফিয়ার মসজিদ রূপান্তরের আদেশ
তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান এর আমলে হায়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের গুঞ্জন উঠে এবং বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ায় । তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালতে একে পুনরায় মসজিদ হিসবে ব্যাবহারের অনুমতি প্রদান করে এবং রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকেও একে মসজিদ হিসেবে ব্যাবহারের ঘোষণা দেয়া হয় । অবশেষে ৮৬ বছর পর তুরস্কের জনগন হায়া সোফিয়ার মিনার থেকে আজানের ধ্বনি শুনতে পেল এবং এতে অনেকেই উচ্ছাস প্রকাশ করে । হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তর করা হলেও তুরস্কের নিয়ম অনুযায়ী যে কোন ধর্মের মানুষেরাই এটি পরিদর্শন করতে পারবে ।
হায়া সোফিয়ার বিস্ময়কর নির্মাণশৈলী

হায়া সোফিয়া মূলত বাইজেন্টাইন স্থাপত্য কলার এক অনন্য-অসাধারণ দৃষ্টান্ত । সম্রাট জাস্টিয়ান তৃতীয় বারের মত যে স্থাপনা তৈরী করেছেন সেটিই মূলত বর্তমানে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে তবে এর মূল কাঠামোর সাথে অটোম্যান সাম্রাজ্যের কিছু সংস্কার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । যেমন- হায়া সোফিয়ার চার পাশে যে মিনার গুলো রয়েছে সেগুলো মূলত অটোম্যান সুলতানদের আমলে তৈরি এছাড়া ভেতরের দিকে আরবি ক্যালিগ্রাফি, নামাজের জন্য মিহরাব ও মিম্বার সেই সাথে চোখ ধাঁধানো ঝাড়বাতি । হায়া সোফিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এর বিশালতা, যা যে কোন পর্যটককে এর অন্যরকম আধ্যাত্মিক আবেশে জড়িয়ে ফেলবে । এর মূল কক্ষ বা হল রুমে প্রবেশ করার পর একজন পর্যটক নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র অনুভব করা শুরু করে । এরকম অনুভূতি তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে হায়া সোফিয়ার বিশালত এবং দৃষ্টি বিভ্রম । এর নির্মাণশৈলী এমন যে এটা বাস্তবে যতটুকু বিশাল তাঁর চেয়ে অনেক বেশী বিশাল মনে হবে আপনার কাছে । বিশালতার পাশা পাশি হায় সোফিয়ার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এর বিশাল আকৃতির গম্বুজ । গম্বুজটি টি ১৫০ ফুট উচু হলেও এর নিচে দাঁড়িয়ে একে আরো অনেক বেশী উচু মনে হয় । আর এটি সোনালী রঙ্গের হওয়াতে অনেকেই একে স্বর্ণের গম্বুজ বলে থাকে । বিশাল এই গম্বুজের নিচের অংশে চারদিকে রয়েছে ৪০ টি জানালা যা দিয়ে দিনের বেলা সূর্যের আলো প্রেবশ করে হল রুমটিকে আপনা-আপনি আলোকিত করে রাখে । সেই সাথে সূর্যের আলো এর ভেতরের সোনালী টাইলগুলেতে প্রতিফলিত হয়ে এমন একটি আলোক আবেশ তৈরী করে যা আপনাকে আধ্যাত্নিকভাবে অন্দোলিত করবে । অনেকেই হায়া সোফিয়ার গম্বুজের এই আলোক আবেশকে বলে থাকেন আধ্যাত্নিক আলো ।
লেখক- ইসমাইল সরকার ( নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily )