লর্ড জোসেফ লিস্টারের জীবনী | জীবাণুমুক্ত অস্ত্রোপচার পদ্ধতি উদ্ভাবক আধুনিক শল্য-চিকিৎসার জনক

মাত্র ১০০ বছর আগেও চিকিৎসকদের মাঝে একটা অদ্ভুত ধারণার প্রচলন ছিলো।তারা ভাবতেন-যিনি যতো বেশি নোংরা থাকতে পারবেন,রোগীরা তাকে ততো বড়ো ডাক্তার বলে মনে করবে।তাই তারা তাদের জামা কাপড়ে ইচ্ছে মতো মেখে নিতেন রক্ত, পুঁজ আর হাড়ের গুঁড়ো। একবার জামা গায়ে চড়ালে এক মাসেও সেটিকে ধুতে দিতেন না তারা।হাসপাতাল পরিষ্কার রাখার পেছনেও তাদের কোনো তাগিদ ছিলো না।ফলে চিকিৎসা করাতে এসে নানা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বেশির ভাগ রোগীকেই ঢলে পড়তে হতো মৃত্যুর কোলে।বিশেষ করে অস্ত্রোপচার করার জন্য যারা হাসপাতালে আসতো,খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতো তাদের ক্ষতস্থান।এভাবে শুধু চিকিৎসকদের ভুল ধারণার কারণেই মৃত্যুবরণ করতে হতো শত শত রোগীকে। তাই সে যুগের রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করাবার চেয়ে বরং বিনে চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরাকেই ভালো মনে করতো।
হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের রোগীদের যখন এমনই দুর্দিন চলছিলো,সে সময় এ সমস্যার সমাধান করার জন্য এগিয়ে আসেন জোসেফ ব্যারন লিস্টার (Joseph Baron Lister) নামে এক তরুণ চিকিৎসক। নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার মধ্য দিয়ে তিনি হাসপাতালগুলোকে করে তোলেন জীবাণুমুক্ত। তাঁর আপ্রাণ চেষ্টায় অস্ত্রোপচার হয়ে ওঠে সুস্থ হয়ে উঠার একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
জোসেফ লিস্টার জন্মগ্রহণ করেন ১৮২৭ সালের ৫ এপ্রিল ইংল্যান্ডের এসেক্সে।তাঁর বাবা জোসেফ জেকসন লিস্টার (Joseph Jackson Lister) ছিলেন রয়েল সোসাইটির সদস্য।ত্রুটিপূর্ণ অণুবীক্ষণ যন্ত্র সারিয়ে তুলতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
স্কুল জীবনের পড়া শেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার জন্য ১৮৪৮ সালে লিস্টার ভর্তি হন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৫২ সালে লিস্টার চলে যান এডিনবরা,বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ ডাক্তার সায়েমের সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য।এ সময় অন্য একটি মেডিকেল কলেজে সার্জারি বিভাগের লেকচারার হিসেবেও খন্ডকালীন কাজ করে যেতে থাকেন তিনি।
ডাক্তার সায়েম ছিলেন প্রতিভাবানদের প্রতি খুবই স্নেহশীল। লিস্টারের মাঝে যে অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, অচিরেই তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাই নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৬ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি তাঁর কন্যা এগনেসকে তুলে দেন লিস্টারের হাতে।
প্রথম থেকেই হাসপাতালগুলোর দুরাবস্থা সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন লিস্টার।এর প্রতিকার সম্পর্কে অনেক চিন্তাভাবনা করে একদিন তিনি একটা সুপারিশনামা পাঠিয়ে দেন রয়েল সোসাইটিতে।লিস্টারের জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে সোসাইটির কর্তা ব্যক্তিরা এতোই অভিভূত হন যে,সাথে সাথে তারা সোসাইটির সদস্য করে নেন লিস্টারকে।
১৮৬৫ সালে লিস্টার প্রথম জানতে পারেন পাস্তুর উদ্ভাবিত জীবাণুতত্ত্বের কথা।ফলে তাঁর কাছে অনেক সমস্যার সমাধানই সহজ হয়ে যায়।লিস্টার বুঝতে পারেন, হাসপাতালের নোংরা পরিবেশ ও চিকিৎসকদের নোংরা জামা-কাপড়ে বাসা বেঁধে আছে যে সব জীবাণু, অস্ত্রোপচার -রোগীর ক্ষতস্থানকে দূষিত করে দেওয়ার জন্য একমাত্র তারাই দায়ী।সুতরাং কোনোভাবে যদি হাসপাতালকে জীবাণুমুক্ত রাখা যায়, তবেই কমে যাবে অস্ত্রোপচার পরবর্তী মৃত্যুহার।কিন্তু কিভাবে হাসপাতালকে জীবাণুমুক্ত রাখবেন তিনি?কি করে তা সম্ভব হবে?
এ সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন ভেবে চলেন লিস্টার।তারপর তাঁর মাথায় আসে এক অতি সাধারণ বুদ্ধি। লিস্টার তখন দরজা-জানালা বন্ধ রেখে, দেয়াল মেঝে পরিষ্কার করে চেষ্টা করেন হাসপাতালকে জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য।কিন্তু তাতেও খুব একটা সুফল পান না তিনি।
মানবজাতির কল্যাণে লিস্টারকে অমন আন্তরিক হতে দেখে আল্লাহ্ সহায় হন তাঁর।আর তাই লিস্টার যখন হাসপাতালকে জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য একটি উপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে ফিরছিলেন, ঠিক সে সময় এক জার্মান বন্ধু চিঠি লিখে তাঁকে জানান যে, সদ্য আবিষ্কৃত কার্বলিক এসিড নামের একটি পদার্থ দিয়ে নর্দমার কীট ধ্বংস করা হচ্ছে তাদের দেশে।রোগ জীবাণু ধ্বংসের জন্য এ এসিডটাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
এ খবর পাবার সাথে সাথে জার্মানি থেকে এক বোতল কার্বলিক এসিড আনিয়ে নেন লিস্টার।এরপর ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে কার্বলিক এসিড দিয়ে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি ধুয়ে নেওয়ার নিয়ম প্রবর্তন করেন তিনি। তাছাড়া অস্ত্রোপচার চলাকালীন সময় একটি স্প্রে মেশিনের সাহায্যে অপারেশন থিয়েটারে কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন তিনি।এতোসবের পরও কার্বলিক এসিডে সিক্ত একটি কাপড় দিয়ে অস্ত্রোপচারের রোগীর ক্ষতস্থান ঢেকে রাখার পদ্ধতি চালু করেন তিনি।ফলে রোগ জীবাণুরা পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় লিস্টারের কাছে।
লিস্টার যখন বুঝতে পারেন তাঁর সাধনা সফল হয়েছে, তখন তিনি এ আবিষ্কারের কথা খুলে জানান তাঁর সহকর্মীদের কাছে।কিন্তু তাতে ভালোর চেয়ে মন্দই হয় বেশি।তারা লিস্টারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে নানাভাবে অপপ্রচার চালাতে থাকে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু লিস্টার তাতে দমে না গিয়ে হাসপাতালকে জীবাণুমুক্ত রাখার পদ্ধতি সম্পর্কে লিখে জানান অন্যান্য দেশের চিকিৎসকদের।ফলে নানা দেশে শুরু হয় কার্বলিক এসিডের ব্যবহার।ভকম্যান নামের এক জার্মান চিকিৎসক লিস্টারের পদ্ধতি প্রয়োগ করে তার হাসপাতালে মৃত্যুর হার নামিয়ে আনেন ৬১ থেকে ৫ ভাগে।আমেরিকার হাসপাতালগুলোতেও লিস্টারের পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে থাকে ব্যাপকভাবে।সেখানে অস্ত্রোপচারের পর রোগীর মৃত্যুর হার নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়। ফলে তাঁর সহকর্মীরাও মেনে নিতে বাধ্য হয় লিস্টারের উদ্ভাবিত পদ্ধতি।
পরবর্তী সময় উত্তাপের মাধ্যমে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতিকে জীবাণুমুক্ত রাখার পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন জোসেফ লিস্টার। তাছাড়া কার্বলিক এসিডের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও কার্যকর করার জন্য তার সাথে ক্যালসিয়াম কার্বনেট ও তিসি তেল ব্যবহার করার পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন তিনি। ফলে সারা বিশ্বে দ্রুত কমে যায় অস্ত্রোপচারজনিত মৃত্যুহার।
সে সময়কার চিকিৎসকরা যে দূষিত রক্ত, পুঁজ ও হাড়ের গুঁড়ো মাখানো কাপড় পরে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতেন,এ বিপজ্জনক মানসিকতার বিরুদ্ধেও প্রথম প্রতিবাদ জানান লিস্টার।তিনি বলেন,চিকিৎসকদের অবশ্যই থাকতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুমুক্ত।এটা তাদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অবদানের জন্য ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার লর্ড উপাধিতে ভূষিত করেন লিস্টারকে।১৮৯৪ সালে তাঁকে ৫ বছরের জন্য রয়েল সোসাইটির সভাপতি মনোনীত করা হয়।১৯০২ সালে পুনরায় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ব্যারন খেতাবে ভূষিত করা হয় তাঁকে।
১৮৯১ সালে চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন লিস্টার।এ সময় সে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লিস্টার ইনস্টিটিটিউশন। এক অনবদ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী ছিলেন। ১৮৬১ সালে তাঁকে গ্লাসগো রয়েল ইনর্ফামারিতে শল্য চিকিৎসকের পদে নিয়োগ করা হয়।এখানে একটানা ৮ বছর কাজ করেন তিনি।এ সময়ই তিনি শল্য চিকিৎসায় পচন নিবারক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।লিস্টারের পচন-রোধক বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। ১৮৬৯ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ক্লিনিক্যাল সার্জারির পদে অধিষ্ঠিত হোন।এখানে কাজ করেন ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত।১৮৭৫ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য জার্মানি সফরে যান লিস্টার।এর ২ বছর পর লিস্টারকে লন্ডনের কিংস কলেজে ক্লিনিক্যাল সার্জারি পদে আমন্ত্রণ জানানো হলে ১৮৭৭ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত একটানা ১৪ বছর সেখানে কাজ করেন তিনি।
ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর উদ্ভাবন করেছিলেন মানবদেহে রোগ ছড়াবার কারণ আর জোসেফ লিস্টার উদ্ভাবন করেছিলেন সেই জীবাণুর হাত থেকে মানুষের জীবনকে রক্ষা করার পদ্ধতি। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এঁরা দুজনই ছিলেন মানবজাতির জন্য এক আর্শীবাদ স্বরূপ। আর এ জন্যই এ ধরনের একটি কথা প্রচলিত আছে যে, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে নানা যুদ্ধ-বিগ্রহে যতো মানুষ মারা গেছে, এঁরা দুজন রক্ষা করেছেন তার চেয়েও বেশি মানুষের প্রাণ।
মহান আবিষ্কারক ও চিকিৎসাবিদ লর্ড লিস্টার মারা যান ৮৫ বছর বয়সে, ১৯১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি।তিনি চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশে সমাহিত হতে।কিন্তু জনগণের চাপে সরকার বাধ্য হয়ে তাঁকে সমাহিত করেন অন্যান্য কৃতী ইংরেজ সন্তানদের পাশে-ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবিতে
ডা.মো.মাহফুজুর রহমান ( ডিভিএম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফেইসবুক প্রোফাইল লিঙ্ক )